চট্টগ্রাম বিভাগের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর নিম্নে আলোকপাত করা হলোঃ
চট্টগ্রাম জেলাঃ
চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। জানা ইতিহাসের শুরু থেকে চট্টগ্রামে আরাকানী মঘীদের প্রভাব লক্ষনীয়। ফলে গ্রামীণ সংস্কৃতিতেও এর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। সে সময় এখানকার রাজারা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হওয়ায় তার প্রভাবও যথেষ্ট। সুলতানি, আফগান এবং মোগল আমলেও আরাকানীদের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই ছিল। ফলে শেষ পর্যন্ত মঘীদের প্রভাব বিলুপ্ত হয়নি। এছাড়া চট্টগ্রামের মানুষ আতিথেয়তার জন্য দেশ বিখ্যাত।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের ইতিহাস সমৃদ্ধ। শেফালী ঘোষ এবং শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবকে বলা হয় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সম্রাট ও সম্রাজ্ঞি। মাইজভান্ডারী গান ও কবিয়াল গান চট্টগ্রামের অন্যতম ঐতিহ্য। কবিয়াল রমেশ শীল একজন বিখ্যাত কিংবদন্তি শিল্পী। জনপ্রিয় ব্যান্ড সোলস, এল আর বি, রেঁনেসা, নগরবাউল এর জন্ম চট্টগ্রাম থেকেই। আইয়ুব বাচ্চু, কুমার বিশ্বজিৎ, রবি চৌধুরী, নাকিব খান, পার্থ বডুয়া, সন্দিপন, নাসিম আলি খান, মিলা ইসলাম চট্টগ্রামের সন্তান। নৃত্যে চট্টগ্রামের ইতিহাস মনে রখার মত। রুনু বিশ্বাস জাতীয় পর্যায়ে বিখ্যাত নৃত্যগুরু। চট্টগ্রামের বিখ্যাত সাংস্কৃতিক সংগঠন হল দৃষ্টি চট্টগ্রাম www.drishtyctg.com, বোধন আবৃত্তি পরিষদ, প্রমা, আলাউদ্দিন ললিতকলা একাডেমি, প্রাপন একাডেমি, উদিচি, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, ফু্লকি, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থা, রক্তকরবী, আর্য সঙ্গীত, সঙ্গীত পরিষদ। মডেল তারকা নোবেল, মৌটুসি, শ্রাবস্তীর চট্টগ্রামে জন্ম । সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয় জেলা শিল্পকলা একাডেমি, মুসলিম হল, থিয়েটার ইন্সটিটিউট।চট্টগ্রামের ‘প্রগতিলেখক সংঘের’প্রতিষ্ঠা, কবিয়াল সমিতি গঠন, নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনের সম্মেলন উপলক্ষে মাণিক বন্দোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ সাহিত্যিক কবির আগমন, ১৯৪৬ খ্রীস্টাব্দের অশান্ত পরিবেশে জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভাব জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে নজরুল জয়ন্তী উদযাপন, প্রগতিশীল মাসিক পত্রিকা সীমান্ত প্রকাশের উদ্যোগ ইত্যাদি ঘটনার মধ্য দিয়ে এর বহিঃ প্রকাশ ঘটে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিখ্যাত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, কবিয়ালরমেশ শীল ও ফনি বড়ুয়া, সুরেন্দ্রলাল দাশ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য
কুমিল্লা জেলাঃ
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত এই জেলাকে ঘিরে রয়েছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, ঢাকা বিভাগ ও চট্টগ্রাম বিভাগের অন্যান্য জেলাসমূহ। এখানে ভাষার মূল বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার মতই, তবুও কিছুটা বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন কথ্য ভাষায় মহাপ্রাণ ধ্বনি অনেকাংশে অনুপস্থিত, অর্থাৎ ভাষা সহজীকরণের প্রবণতা রয়েছে। কুমিল্লার দাউদকান্দি, তিতাস, মেঘনা, হোমনা প্রভৃতি উপজেলার আঞ্চলিক ভাষার সাথে সন্নিহিত ঢাকা অঞ্চলের ভাষার, চৌদ্দগ্রাম ও লাকসাম উপজেলার আঞ্চলিক ভাষায় নোয়াখালি এলাকার ভাষার অনেকটাই সাযুজ্য রয়েছে। মেঘনা-গোমতী নদীর গতিপ্রকৃতি এবং লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে কুমিল্লার মানুষের আচার-আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা, সংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
এই এলাকার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে কুমিল্লার সভ্যতা বহু প্রাচীন। এই এলাকায় প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ প্রাচীন সভ্যতার বাহক হিসেবে দেদীপ্যমান। এছাড়াও এ এলাকায় কিছু ক্ষুদ্র জাতিসত্বা বসবাস করে যাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে কুমিল্লার অবদানও অনস্বীকার্য। সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান, ওস্তাদ আয়েত আলী খান, ওস্তাদ আকবর আলী খান প্রমুখ ভুবন বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ স্মৃতি বিজড়িত কুমিল্লা। কুমিল্লার ওস্তাদ আফতাবউদ্দিন খান সরোদের মত দেখতে সুর সংগ্রহ যন্ত্র উদ্ভাবন করেন। এছাড়াও তিনি মেঘ ডাবুর যন্ত্র নামে সুরযন্ত্রের স্রষ্টা। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান চন্দ্র সারং এবং ওস্তাদ আয়েত আলি খান আধুনিক সরোদ উদ্ভাবন করেন। কুমিল্লার বাঁশের বাঁশি সমগ্র উপমহাদেশে প্রসিদ্ধ।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান সৃষ্ট রাগ সঙ্গীত, হেমমত্ম দুর্গেশ্বরী, মেঘ বাহার, প্রভাতকেলী, হেম বেহাগ, মদন মঞ্জরী রাগ এবং ওস্তাদ আয়েত আলী খান সৃষ্ট মিশ্র রাগ উপ মহাদেশের শাস্ত্রীয় গীতধারায় এখনও প্রবল প্রভাব রেখে চলেছে। ওস্তাদ আলী আকবর খান ১০টি নুতন রাগ সৃষ্টি করেন। এগুলো হলো রাগ চন্দ্রনন্দন, গুরুমঞ্জরী, লাজবন্তি, মিশ্র শিবরঞ্জনী, ভুপমন্দ, মেধাবী, আলমগীরি, মলয়ালম স্মৃতি, কুশিযোগি এবং রাগ চৌরাঙ্গ কল্যাণ।
যেসব সরকারী সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা কুমিল্লায় কাজ করছে সেগুলো হলোঃ
* জেলা শিল্পকলা একাডেমী, কুমিল্লা
* বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, কুমিল্লা জেলা শাখা
* সরকারী গণ গ্রন্থাগার, জজকোর্ট রোড, কুমিল্লা
* স্থানীয় সরকার ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুদানপ্রাপ্ত সংস্থা বীরচন্দ্রনগর মিলনায়তন (টাউনহল)
* নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্র, কুমিল্লা
ফেনী জেলাঃ
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত এ জেলাকে ঘিরে রয়েছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম । দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর এর বৈচিত্র্যময় জলরাশি। এখানে ভাষার মূল বৈশিষ্ট্য আবেগ প্রবণতায় অপরকে আপনীকরণের প্রচেষ্টা,এর মাঝে ও ভাষায় কিছুটা বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন ফেনীর কথ্য ভাষায় মহাপ্রাণ ধ্বনিসমূহ উচ্চারণের ক্ষেত্রে বায়ুপ্রবাহের চাপ কম থাকায় মহাপ্রাণ ধ্বনিসমূহ অল্পপ্রাণ ধ্বনির মত উচ্চারিত হয় আবার অল্পপ্রাণ ধ্বনিসমূহ উচ্চারণের ক্ষেত্রে বায়ুপ্রবাহের চাপ বেশি থাকায় অল্পপ্রাণ ধ্বনিসমূহ মহাপ্রাণ ধ্বনির মত উচ্চারিত হয় । বর্ণ উচ্চারণে সহজতর বর্ণ ব্যবহার করা হয় অধিক হারে এবং প্রয়োজনে বর্ণকে ভেঙে কাছাকছি অবস্থান উচ্চারণ অবস্থান বেছে নেওয়া হয় অর্থাৎ ভাষা সহজীকরণের প্রবণতা সুস্পষ্ট। এর অন্যতম আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বাংলাদেশের যে কোন অঞ্চলের মানুষ ফেনীর আঞ্চলিক ভাষাকে সহজভাবে বুঝতে পারে এবং সহজেই এ আঞ্চলিক ভাষাটিকে নিজের কন্ঠে ধারণ করতে পারে। ফেনীর আঞ্চলিক ভাষার সাথে কুমিল্লা অঞ্চলের চৌদ্দগ্রাম ও লাকসাম উপজেলার আঞ্চলিক ভাষার এবং চট্রগ্রাম অঞ্চলের মিরেরশ্বরাই, বারইয়ারহাট অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার মিল সুস্পষ্ট । নোয়াখালি ও লক্ষীপুর এলাকার ভাষার অনেকটাই সাযুজ্য রয়েছে ফেনীর আঞ্চলিক ভাষার সাথে ।
আঞ্চলিক সংস্কৃতিতে মুখে মুখে ছড়াকাটা, ধাঁধাঁ, বচন ইত্যাদি প্রচলিত। প্রাচীন ভূলভূলাইয়া নদীর (বর্তমানে অস্তিত্বহীন) তীরবর্তী মানুষগুলোর বাণিজ্যযাত্রা ও বণিকের নিয়তি ও প্রেমকাহিনী নিয়ে রচিত ভূলুয়ার পালা এ অঞ্চলের প্রাচীন সংস্কৃতির নিদর্শন। পালা গান,কবি লড়াই, ঢাকী নৃত্য এর পাশাপাশি পুঁথিসাহিত্যে শমসের গাজির কিচ্ছা, ভূলুয়ার কিচ্ছা সুপরিচিত। বীর শমসের গাজীর বীরত্ব গাঁথা মানুষের মুখে মুখে, পণ্ডিত হাবিবুল্লার পাণ্ডিত্য উপমহাদেশের সীমায় প্রসারিত।মহান বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে শহীদ সালাম, সু-মহান একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবী প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার শহীদ জহির রায়হান, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার, প্রখ্যাত সাংবাদিক শহীদ সেলিনা পারভীন এবং সদ্য প্রয়াত নাট্যাচার্য ড: সেলিম আল দীন এই মাটির সন্তান যাঁদের নিয়ে গর্ব করে বাংলাদেশ, গর্বিত হয় বিশ্ব। বর্তমান সময়ের সংস্কৃতির আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র ড: ইনামুল হক. লাকী ইনাম, শমী কায়সার, তরু মোস্তফা, গিয়াস উদ্দিন সেলিম প্রমুখ নাট্য ভাবনায় যোগ করছেন নতুনত্ব,এগিয়ে নিয়ে চলেছেন বাংলা নাটককে।
ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলাঃ
এই উপমহাদেশের সঙ্গীত জগতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নামে স্বর্ণাক্ষরে খচিত। এখানে জন্ম নিয়েছেন সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, মহর্ষি মনোমোহন দত্ত, রওশন আর অন্নপূর্ণা, ওস্তাদ বাহাদূর হোসেন খান, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু এবং সৈয়দ আব্দুল হাদী প্রমুখ সঙ্গীত সাধক। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সঙ্গীতে তীর্থভূমি শিবপুর, সাতমোড়া, মইনপুর এবং কালীকচ্ছ। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে এটাই সত্য গোটা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা-ই সঙ্গীতের উর্বর শস্যভূমি। তিতাস নদী বিধৌত এই ভূ-ভাগে আদিকাল হতে গড়ে উঠেছে ঋদ্ধ সঙ্গীত ঐতিহ্য।
শহরে সাহিত্য কর্মে যারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন তারা হলেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, আবদুল কাদির প্রমুখ।১৯৫৭ সালে ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ "দি আলাউদ্দিন মিউজিক্যাল কলেজ" এবং ১৯৭৫ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন "দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন" গড়ে তোলেন। সঙ্গীতে এ শহরে যারা বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন তারা হলেন ওস্তাদ ফকির (তাপস) আফতাব উদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খাঁ, ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খাঁ, ওস্তাদ আবেদ হোসেন খাঁ, ওস্তাদ খাদেম হোসেন খাঁ, ওস্তাদ রাজা হোসেন খান, অমর পাল, ওস্তাদ খুরশিদ খান, ওস্তাদ সুবল দাস, ওস্তাদ আফজালুর রহমান, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, সবদর হোসেন খান, মনোমোহন দত্ত, লোকশিল্পী দুলা মিয়া, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খান, রওশনআরা বেগম (অন্নপূর্ণা), সৈয়দ আবদুল হাদী প্রমুখ।
লোক সংগীতেও সমৃদ্ধ জনপদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া। লোক সংগীতে প্রাচীনকাল থেকেই একটি বিশেষ ধারা এখানে প্রচলিত হয়েছে। মৃরজা হোসেন আলী, বানচন্দ্র তর্কালঙ্কার, মনোমোহন দত্ত, লবচন্দ্র পাল, ফকির আফতাব উদ্দিন, দুলা মিয়া মাস্টার, গিরীন চক্রবর্তী ও দূর্গাচরণ দাসের লোক সংগীত সারা উপমহাদেশেই গ্রহণ যোগ্য হয়েছে।
রাঙ্গামাটি জেলাঃ
জনবৈচিত্র্যর এক অনন্য মিলন ক্ষেত্র রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা । এখানে দশভাষাভাষি এগারটি জাতি সত্ত্বার বসবাস রয়েছে। এরা হচ্ছে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, চাক, খিয়াং, খুমী, পাংখোয়া, বোম ও লুসাই। ভাষাও সংস্কৃতির বিচারে এক জাতিসত্ত্বা অন্য জাতিসত্ত্বা থেকে স্বতন্ত্র।নৃতাত্ত্বিক বিচারে তাদের সকলেই মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠিভুক্ত। সংখ্যাগরিষ্ঠতারদিক থেকে ‘চাকমা’হচ্ছে প্রধান জাতিসত্ত্বা। তাদের পরেই মারমা, ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের অবস্থান।
এতদঞ্চলেবসবাসরত প্রত্যেক জাতিসত্ত্বার রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। এদের মধ্যেচাকমাদের রয়েছে নিজস্ব বর্ণমালা। মারমারা বর্মী বর্ণমালায় লেখার কাজ চালায়।তাদের লোক সাহিত্যও বেশ সমৃদ্ধ। লোক সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে প্রবাদ-প্রবচন(ডাগকধা), ধাঁধাঁ (বানা), লোককাহিনী, ছড়া উভগীদ ইত্যাদি। এগুলোর ব্যবহার ওরচনা শৈলী বেশ চমকপ্রদ। লোককাহিনীর বুননেও উৎকর্ষতার ছাপ রয়েছে। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা আধুনিক সাহিত্য চর্চায়ও অনেকটা এগিয়েছে। তারা নিজেদেরভাষায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি রচনা করছে।
পোশাক-পরিচ্ছদও অলংকার ব্যবহারের ক্ষেত্রে পার্বত্য আদিবাসীদের শিল্পমননশীলতার পরিচয়মেলে। চাকমাদের পিনন-খাদি, মারমাদের লুঙ্গি-থামি, ত্রিপুরাদের রিনাই-রিসাউৎকৃষ্ট শিল্পকলার পরিচয় বহন করে। সুদূর অতীতে মেয়েদের শুধু রূপার গহনাপরতে দেখা যেত। লুসাই, পাংখো ও বম মেয়েরা পরতো বাঁশ-কাঠের অলংকার। আবার কেউকেউ পুঁতির মালা কিংবা মুদ্রার মালা পরতো। কানে পরতো দুল আর ঝুমকো।পুরুষরা পরতো মালকোচা ধুতি এবং লম্বা হাতা জামা। বর্তমানে পেশাক-পরিচ্ছদেবেশ পরিবর্তন এসেছে। এখন সকল জাতিসত্তার মেয়েদের সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি-ব্লাউজ এবং পুরুষদের পেন্ট-শার্ট পরতে দেখা যায়।
এতদঞ্চলেরআদিবাসী সংস্কৃতি অত্যন্ত উজ্জ্বল এবং বৈচিত্রময়। এখানকার ১১টি জাতিসত্তার বিশাল সংস্কৃতির ভান্ডার রয়েছে।তারা পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতির ধারাপরম মমতায় যুগ যুগ ধরে রক্ষা করে চলেছে। আধুনিক শিক্ষা, মোঘল-ইংরেজ-বাঙালিসংস্কৃতির ছোঁয়া, নগরায়ন ও আকাশ সংস্কৃতি আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকেযথেষ্ট প্রভাবিত করেছে তা ঠিক। এতে তাদের ভাষা, পোশাক, আহার ও জীবন ধারায়পরিবর্তনও লক্ষনীয়। পার্বত্যউপজাতি জনগোষ্ঠির মধ্যে বৌদ্ধ, সনাতন, খ্রিস্টান ও ক্রামা ধর্ম প্রচলিত।এখানে আচার সংস্কার বিষয়ে বেশ কিছু টোটেমিক ধারণা প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরেরপুরহিতদের পাশাপাশি পাহাড়ি ওঝা, বৈদ্য ও তান্ত্রিকদের প্রভাবও লক্ষ করাযায়। সমাজে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন রীতিনীতি মেনে চলে সবাই। লোক সংস্কার ও লোকবিশ্বাসকে মনে প্রাণে ধারণ করে সেটা থেকে শুভ-অশুভকে বিচার করা হয় কখনওকখনও।
পার্বত্যচট্টগ্রামের প্রধান সামাজিক উৎসব ‘বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুক’। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যারা বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমণ উপলক্ষে তিনদিনব্যাপী এউৎসব পালন করে। চাকমাদের ‘হাল পালানী’উৎসব কৃষি ভিত্তিক।মারমাদের‘ছোয়াইংদগ্রী লং পোয়েহ’ও ‘রথটানা’উল্লেখযোগ্য। ‘খিয়াং উপজাতিদের প্রধানউৎসব ‘হেনেই’। আর ‘লুসাইদের নবান্ন উৎসবের নাম ‘চাপ চার কুট’। ম্রোদেররয়েছে ‘গো-হত্যা’উৎসব। বর্তমানে ‘কঠিন চীবর দান’প্রধান ধর্মীয় উৎসবেপরিণত হয়েছে।চাকমাদেরজনপ্রিয় নৃত্য হচ্ছে ‘জুমনৃত্য’।লুসাইদের লোকনৃত্যের মধ্যে ‘বাঁশ নৃত্য’ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তালাভ করেছে।
নোয়াখালী জেলাঃ
আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-ভৌগোলিক বহুবিধ অনুষঙ্গের কারণে অঞ্চলবেধে সংস্কৃতি ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা রুপ পরিগ্রহ করে। তাই একটি দেশের সামগ্রিক লোকসংস্কৃতি এবং একটি বিশেষ অঞ্চলের লোকসংস্কৃতিতেও অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। নোয়াখালী জেলা প্রাচীন সমতট জনপদের একাংশ। তাই স্বাভাবিকভাবেই জেলার লোকসংস্কৃতিতে তার একটি পরিচ্ছন্ন ছাপ পরিলক্ষিত হয়।লোক সংস্কৃতির একটি প্রধানতম শাখা লোকসাহিত্য। নোয়াখালীর লোক সাহিত্য এ দেশের অন্যান্য অঞ্চলেরতুলনায় অনেকটা সমৃদ্ধ এবং জীবন ঘনিষ্ঠ; তা এ অঞ্চলের প্রবাদ-প্রবচন, আঞ্চলিক গান, ধাঁ-ধাঁ, ছড়া থেকে সহজেই অনুমেয়।
প্রবচনের কথাই ধরা যাকঃ“মাইনষের কুডুম আইলে গেলে, গরুর কুডুম লেইলে হুঁইছলে”এ প্রবচনটি গুঢ়ার্থ হলো মানুষের কুটুম্বিতা তথা আতিথেয়তা বুঝা যায় পরস্পরের আসা যাওযার মাধ্যমে আর গরুর তা বোঝা যায় লেহনের মাধ্যমে। এ প্রবচনের অর্থের সাথে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষ যে ঐতিহ্যগতভাবেই আত্মীয় বৎসল তা বুঝতে বাকী থাকার কথা নয়।
প্রত্যাহিক জীবনের নানা উপকরণ নিয়ে রয়েছে হাজারো বৃদ্ধিদীপ্ত মুখরোচক ধাঁধাঁ। এছাড়াও বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে নিয়ে দেখা যায় শত শত ছড়া, পদ-পদ্য এমনি প্রশ্নোত্তর ভিত্তিক একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত ছড়া হচ্ছে-আচ্ছালামালাইকুম এয়, দুলা আইছে বিয়া কইত্তো আন্নেরা আইছেন কেয়া। উত্তরে-“ওআলাইকুম আচ্ছালাম ওবা, দুলা আইছে কিয়া কইত্তো আমরা আইছি শোবা”।এ অঞ্চলের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবেই রসপ্রিয় এবং তাদের রসবোধ জীবন ঘনিষ্ঠ এবং একান্ত নিজেদেরই মত। রঙমালা চৌধুরীর পালা, বেদের মেয়ে ইত্যাদি এ অঞ্চলের মৌলিক রচনা ও উপস্থাপনা। কিং এডওয়ার্ড আর সিম্পসনের প্রণয় “চৌধুরী রঙমালা” র প্রণয় অপেক্ষা শক্তিশালী বলে বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। লোক-সাহিত্যের কথা বাদ দিলেও এ অঞ্চলের জন জীবনে যে ঐতিহ্য লালিত তার শিল্প বোধ ঈর্ষণীয় বলতে হবে।
লক্ষ্মীপুর জেলাঃ
লক্ষ্মীপুর জেলার ইতিহাস অতিপ্রাচীন নয়। তেমনি এ জেলার সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসও অনেক পুরাতননয়। কিন্তু জেলাবাসীর সংস্কৃতির গভীর ঐতিহ্য রয়েছে। সমুদ্রপথে আগতবিদেশী(তুর্কীমোগল, পাঠান, ফিরিঙ্গী) এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত বসতি সমূহ জারি-সারি কীর্তন, যাত্রা ও কবিগানের প্রচলন ছিল। গৃহস্থবাড়ীসমূহেব য়াতিগান ও পুঁথি পাঠের আসর ছিল জমজমাট। পরবর্তীকালে যোগহয় যাত্রাপালা ও নাটক।
১৯২৬ খ্রি: জুন মাসে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম এসেছিলেন লক্ষ্মীপুর হাই স্কুল প্রাঙ্গণে। কবি দরাজ কন্ঠে সংগীত পরিবেশন করেন: জাগো রে চাষী ভারত বাসী, শিকল পরার ছল, দুর্গম গিরি কান্তার মরু ইত্যাদি। কবিকে সংবর্ধনার উপহার হিসাবে একখানা রূপার থালা ও রূপার বাটি উপহার দেয়া হয়। পরে কবি লক্ষ্মীপুর টাউন হলে রাত্রিযাপন করেন। ১৯৪১ খ্রিঃ শাখারীপাড়ার ডাঃ রমেশ চন্দ্র কর রক্ষাকালী অপেরা দল প্রতিষ্ঠা করেন। এদের অভিনীত যাত্রাগুলোর বেশীর ভাগই ছিল ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় পালা। এ সময়ই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুসলিম ড্রামাটিক ক্লাব’ যারা প্রতি সপ্তাহে একটি করে নাটক মঞ্চস্থ করতে থাকেন। তখনকার যুগে কোলকাতা সহ সারা বাংলাদেশে ৬ খানা পাকা মঞ্চ ছিল। যার মধ্যে একটি ছিল লক্ষ্মীপুরে। তখনকার সময় বাণী রঙ্গালয়, মন্দির, যুগীহাটা, লঙ্গর থানা, টাউন হলে নাটক হতো। বিশিষ্ট অভিনেতা ছিলেন খ্যাতনামা আইনজীবি কুন্তলাল কৃষ্ণ মজুমদার, রমনী মোহন গুপ্ত, অশ্বিনী কুমার চৌধুরী, গৌরাঙ্গ পেমের নরেন্দ্র চক্রবর্তী (নরা ঠাকুর), বুদাদা (আদালতের সামনে চায়ের দোকানদার) প্রমুখ।
১৯৫৬ সালে জুবিলী দিঘীর পাড়ে মিঞা আবু তাহের ও রেজাউল হাকিমের নেতৃত্বে গড়ে উঠে সবুজ সংঘ। তাদের সহযোগিতা করেন গোলাম রহমান, শশী চক্রবর্তী, অসীম চক্রবতী, মতিলাল নাগ, লাবণ্য সেন গুপ্ত। উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেন আবদুল হাকিম উকিল ও কুন্তল কৃষ্ণ মজুমদার। এর পর বিশিষ্ট অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার, গোলাম রহমান, হিমাদ্রি, মুখার্জী সহ কয়েকজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তির উদ্যোগে লক্ষ্মীপুর পাবলিক লাইব্রেরী ও টাউন হলকে সংস্কার করার জন্য ১৯৫৮ খ্রি: একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়। সে কমিটির সাধারণ সম্পাদক হলেন রামেন্দু মুজমদার এবং সাংস্কৃতিক সম্পাদক হলেন গোলাম রহমান। তাদের উদ্যোগে ১৯৫৮ খ্রি: দুটি নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। তখন থেকে পুনরায় লক্ষ্মীপুর জেলায় সাংস্কৃতিক চর্চার প্রাণ পায় বলে ধরে নেয়া যায়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এ দেশের সংস্কৃতি নতুন প্রাণ পায়। লক্ষ্মীপুর পাবলিক লাইব্রেরী ও টাউন হল কেন্দ্রিক নাটক, সংগীত, নৃত্যনাট্য বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেয়া হয়।জেলা শিল্পকলা একাডেমী, জেলা শিশু একাডেমী, বঙ্গবন্ধু শিল্পী গোষ্ঠী, উদীচি শিল্পী গোষ্ঠী, খেলাঘর আসর, নন্দীনি সাহিত্য পাঠ চক্র, মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক কমান্ড, নজরুল একাডেমী, জাতীয় কবিতা পরিষদ, কমিউনিটি পুলিশিং সাংস্কৃতিক কমিটি।
এ জেলায় গর্ভধারণ করে আছেন অসংখ্য প্রথিতযশা ব্যক্তিগণ যারা দেশেবিদেশে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সুনামের সাথে অবস্থান করেছিলেন এবং করছেন, তারা হলেন, অভিনেতা মরহুম মোজাম্মেল হোসেন বাচ্চু, অভিনেত্রী মরহুম রোজী আফসারী, প্রখ্যাত লেখক ও কলামিষ্ট মরহুম ছানা উল্যা নুরী, অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার, অভিনেত্রী দিলারা জামান, অভিনেতা এটিএম শামসু জামান, নায়ক মাহফুজ আহমেদ, নাট্যকার, অভিনেতা ও ডকুমেন্টারী ফ্লিম মেকার বাবুল বিশ্বাস, উপস্থাপক ইব্রাহিম ফাতেমী, পরিচালক ইসমাইল হোসেন, পরিচালক অরন্য আনোয়ার।
কক্সবাজার জেলাঃ
কক্সবাজার জেলার ভূ-প্রকৃতি ও ভৌগলিক অবস্থান এই জেলার মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি গঠনে ভূমিকা রেখেছে।এই জেলার মানুষ সাধারনত চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে ,তবে কথ্য ভাষায় অনেক ক্ষেত্র কক্সবাজার কেন্দ্রিক শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যায়।যেমন- বাংলাভাষায় পরিচিত কারো সাথে দেখা হলে আমরা জানতে চাই, আপনি কেমন আছেন? এই কথাটি এখানকার মানুষ বলে এভাবে, ''য়নেঁ গম আছন্নে?'' ঐতিহাসিক ভাবে এ অঞ্চলের মানুষের সাথে বর্তমান মায়ানমার পুর্বে যাকে আরাকান নামে অভিহিত করা হতো তাদের সাথে ব্যাপক গমনাগমনের সর্ম্পক ছিল যা এখন ও সীমিত আকারে হলেও অটুট রয়েছে। এ কারণে আরকানের ভাষার কিছু কিছু উপাদান কক্সবাজারের কথ্য ভাষায় মিশ্রিত হয়ে গেছে। এই উপজেলায় নৃতাত্বিক রাখাইন জনগোষ্ঠী বসবাস করে।যাদের ভাষার প্রভাব স্থানীয় ভাষায় লক্ষ্য করা যায়।
সমুদ্র তীরবর্তী শহর হিসেবে কক্সবাজার জেলার সংস্কৃতি মিশ্র প্রকৃতির। পুর্ব হতেই বার্মার সাথে এ অঞ্চলের মানুষের সম্পর্ক থাকায় এবং রাখাইন নামক নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠী বসবাস করায় কক্সবাজারে বাঙালী এবং বার্মিজ সংস্কৃতির এক অভূতপুর্ব সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে রাখাইন সংগীত এবং নৃত্যকলা এ অঞ্চলতো বটেই বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। সমুদ্রতীরবর্তী হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষ প্রাচীনকাল হতেই দুর্যোগিএবং উত্তল সাগরের সাথে সংগ্রাম করে টিকে রয়েছে বিধায় স্থানীয সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যম ও উপস্থাপনায় সংগ্রামের সেই চিত্র ফুটে ওঠে, বিশেষ করে জেলে সম্প্রদায়ের প্রাত্যাহিক জীবন।
খাগড়াছড়ি জেলাঃ
পৃথিবীর সকল জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রত্যেক জাতি বা জনগোষ্ঠীর পৃথক বংশ পরিচয়-ইতিহাস রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১৩ টি উপজাতির জীবন যাত্রা স্বতন্ত্র, বৈচিত্রময় কিন্তু সহজ সরল। এই নৃগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমা পর্যায়ক্রমিক সংখ্যাগরিষ্ঠ।
দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রথম ‘‘চাগমা’’ শব্দের অস্তিত্ত্ব এবং ষোড়শ শতাব্দীতে এ অঞ্চলে এ নামের একটি জনগোষ্ঠীর বসবাসের তথ্য পাওয়া যায়। এই ‘‘চাগমা’’ জাতিগোষ্ঠী শাব্দিক বা উচ্চারণগত দিক থেকে যাই হোক না কেন এরাই যে বর্তমানে ‘‘চাকমা’’ নামে পরিচিত জনগোষ্ঠী তাতে কোন সন্দেহ নেই। চাকমারা মূলত: বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং ‘‘বিজু’’ তাদের প্রধান সামাজিক উৎসব। চাকমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ‘‘জুম নৃত্য’’ দেশে-বিদেশে দারুণভাবে প্রশংসিত। তুলনামূলকভাবে চাকমারা অধিক শিক্ষিত। তবে চাকমা উপজাতীয় রমণীরা অত্যন্ত কর্মঠ ও পরিশ্রমী। চাকমাদের মধ্যে প্রচলিত কথ্য ভাষার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে ষ্পষ্টত: প্রমাণিত হয় যে, তা বাংলা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষারই অপভ্রংশ। চাকমারা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার অপভ্রংশের মতো উচ্চারণ রীতি ব্যবহার করলেও চাকমা ভাষার বর্ণমালা বর্মী আদলে তৈরি।
পার্বত্য জেলাসমূহে মারমারা সংখ্যায় দ্বিতীয় হলেও খাগড়াছড়িতে এরা তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজাতি। বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলাতেই মূলত: এদের বসবাস। মারমারা অত্যন্ত অতিথিপরায়ন। এ জনগোষ্ঠীর মেয়েরা অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং তাদের প্রধান সামাজিক উৎসব ‘‘সাংগ্রাইং’’। সাধারণত: মারমা বর্ষপঞ্জি ঘোষণাপত্র ‘‘সাংগ্রাইংজা’’ এর মাধ্যমে চান্দ্রমাস অনুসারে মারমারা তাদের প্রধান সামাজিক উৎসব ‘‘সাংগ্রাইং’’ পালন করে থাকে। বহু পূর্বে মারমারা ‘‘মগ’’ নামেই পরিচিতি ছিল। বর্তমানে তারা নিজেদের ‘‘মারমা’’ বলেই দাবি করে। ‘‘মারমা’’ শব্দটি ‘‘মারমাজা’’ বা ‘‘ম্রাইমাচা’’ নামক উপমহাদেশীয় প্রাচীন ব্রাহ্মী হস্তাক্ষর লিপি থেকে উদ্ভুত।মারমা জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী থালা নৃত্য, প্রদীপ নৃত্য, পরী নৃত্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ত্রিপুরারাই ইতিহাস সমৃদ্ধ জাতি। খ্রিষ্স্টাব্দ গণনার বহু পূর্ব হতেই এ অঞ্চলে ত্রিপুরাদের অস্তিত্ত্ব ছিল। মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী অংশ নিয়েছিল বলে জানা যায়। ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা রাজা যুঝারুফা কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ের পর স্মারক হিসেবে ‘‘ত্রিপুরাব্দ’’ প্রবর্তনের পর হতে ত্রিপুরাদের লিখিত ইতিহাসের সূচনা ঘটে। সঠিক তথ্য জানা না গেলেও বহু আদিকাল থেকে এ অঞ্চলে ত্রিপুরাদের বসবাস ছিল। অধ্যাপক শাহেদ আলী তাঁর ‘‘ বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান’’ বইয়ে লিখেছেন - পাহাড়ী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ত্রিপুরারাই সবচেয়ে সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী। ত্রিপুরারা সনাতন ধর্মাবলম্বী। তাদের প্রধান উপজীবিকা কৃষি তথা জুমচাষ। তাদের প্রধান উৎসব ‘‘বৈসাবী’’। উপজাতি প্রায় সকল রমণীরাই নিজেদের তৈরি তাঁতে বোনা কাপড় পড়ে। এদের পরনের কাপড়কে ‘‘রিনাই’’, ‘‘রিসাই’’ বলে। রূপার তৈরি অলংকার ত্রিপুরা রমণীদের খুব প্রিয়। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী ‘‘গড়াইয়া’’ ও ‘‘বোতল নৃত্য’’ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ত্রিপুরাদের মধ্যে ‘‘রোয়াজা’’ উপাধি ধারীরাই সামাজিক বিচার আচার করে থাকে।
বান্দরবান জেলাঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট ১১টি নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর বসতি রয়েছে। এরা হচ্ছেন মারমা, চাকমা, মুরং, ত্রিপুরা, লুসাই, খুমি, বোম, খেয়াং, চাক, পাংখো ও তংচংগ্যা । এ ১১টি জাতিগোষ্ঠির বসবাস রয়েছে একমাত্র বান্দরবান জেলাতে। বান্দরবান জেলায় বসবাসকারী উপজাতী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংখ্যা গরিষ্ঠ সম্প্রদায় হলো ‘‘মারমা’’। তারা মূলতঃ ম্রাইমা নামে বার্মা হতে এসে বসতি স্থাপন করেছে অত্র এলাকাতে।
বান্দরবানের ২য় বৃহত্তর উপজাতি জনগোষ্ঠী মুরং(ম্রো)সম্প্রদায়।তাঁরা বার্মার আরাকান রাজ্য হতে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে খুমীদের সাথে প্রচন্ড সংঘর্ষে পরাজিত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে এসে বসতি গড়ে তোলে। এ জেলায় ৩য় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হল ত্রিপুরা।
ইতিহাস বলে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ উপজাতিই এসেছে পাশ্ববর্তী দেশ বার্মা, চীন, ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্য হতে। সে কারণে এ অঞ্চলের উপজাতিদের সাথে পাশ্ববর্তী রাষ্ট্রের উপজাতি বা আদিবাসীদেরও মিল পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ থেকে জানা যায় যে, সুপ্রাচীন কাল থেকেই পার্বত্য এলাকায় অ-উপজাতীয় জনগণের বসতি ছিল, যদিও মোঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁর আমলে( ১৬৬৬) তাদের দৃপ্ত পদচারণা লক্ষণীয়। ১৭৬০ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল মোগল সম্রাটের অধীন। তখন চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ গোটা এলাকাটির নাম ছিল ইসলামাবাদ। ১৫১৮ সালে বাংলাদেশ ভ্রমণকারী পর্তুগীজ বনিকের বর্ণনামতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলা ভাষাভাষীদের বসবাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
এ জেলায় বসবাসরত নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির রয়েছে আলাদা আলাদা ভাষা ও সংস্কৃতি। এদের অনেক রীতিনীতি, কৃষ্টি, সামাজিক জীবনাচার ও গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে মহামান্বিত ও বৈচিত্র্যময় করেছে। এক সময়ের প্রচলিত রাজ প্রথা ও রাজ পূণ্যাহ্ অনুষ্ঠান মূলত: এ জেলাতেই হয়ে থাকে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস